মোহা: আজাহারউদ্দিন, টিডিএন বাংলা : অন্ধকার যুগে আরব ভূখন্ডে আমাকে জন্মের সাথে সাথে বালি খনন করে পুতে দেওয়া হত। ১৮২৯ সালের পূর্বে কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষে আমাকে দাহ করা হত । আর বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অত্যাধিক ষড়যন্ত্রে আমাকে ভ্রুনেই বিনাশ করা হচ্ছে। যুগযুগান্তরে আমাকে নিধনের নানা কৌশল অব্যহত।আমি পুঁজিবাদীদের পণ্য, ধর্ষকের ভোগ্য, শশুর গৃহের গল্পগুচ্ছের নিরুপমা, গোড়া ধার্মিকের চোখে সন্তান উৎপাদনের ভূমি, ফেরাউনের দৃস্টিতে অবাধ্য, প্রেমিকের হৃদয়ে সন্দেহ আবার কারোর দৃস্টিতে বারাঙ্গনা। সর্বোপরি সবার দৃস্টি কিন্ত আমার উপরেই।

আমার জন্মের পরে আমার পিতার মুখশ্রী বিকৃত হয়ছিল কেন জানেন?। আমি জাতে নারী বলে । যে পরিবারে আমার জন্ম হয় সেই পরিবারে আজও আমার মাকে বাঁকা দৃস্টিতে দেখা হয় আমার মতো নারী জন্ম দেওয়ার অযোগ্য অপরাধের জন্য। আমার জাতের জন্মে নাকি দূর্ভাগ্য ডেকে আন! যুগ-যুগান্তরে ও দেশ-দেশান্তরে সর্বোত্রই আমি চার দেওয়াল অতিক্রম করতে পারেনি।
আমরা জানি পৃথিবীর সমস্ত নর ও নারী আদম ও ইভের সন্তান। পৃথিবীর অপরাধের সূচনার নৈপথ্যে ছিল আমার প্রতি লোভাতুর দৃস্টি।যার জন্য কাবিল আমাকে বিয়ে করার জন্য হাবিলকে হত্যা করে এই জগতে অপরাধের সূচনা করে। আজও কি সেই দৃস্টির পরিবর্তন হয়েছে? খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, খ্রিষ্টাব্দ,হিজরি, সন-সাল পেরিয়ে আমি আজও কেন জল-জঙ্গলের সহবস্থানে?
বন্ধু আপনি কি জানেন আপনার শৈশবের লালন-পালন, দম্ভের পায়চারী, পাহাড়কে বিদীর্ণ করার চেস্টা, লোলুপ দৃস্টি ও প্রেমের ভরে বেঁচে থাকার আশা চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত যদি আমি সৃস্টি না হতাম। কোন গৌরবের বদলতে এত ধৃস্টতা দেখাও?

শৈশব থেকে বয়োসন্ধিতে আমি যখন পদার্পন করলাম আমি নারী হওয়ার অপরাধে পৃথিবীর সব দায়িত্ব যেন আমারর উপরেই ন্যস্ত হল। বাড়িতে পিতা দুটো ফল কিনে বাড়িতে নিয়ে এলে সেরাটা ছেলেকে দেওয়া হয়। ছেলেকে সেরা স্কুলে ভর্তি করা হয়। ছেলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় যেতে পারে কিন্ত আমাকে হাইস্কুলের গন্ডি পেরোতে বিদ্রোহ করতে হয়।ছেলে চল্লিশে বিয়ে করলেও সমস্যা নায় কিন্ত আমার বয়স ষোলো হলেই পাড়ায় গুঞ্জন শুরু হয়। আর বিয়ে রুখতে আমাকে থানা যেতে হয়। পুরুষ হাজারো নারীর সাথে গোপন রাখলে দোষ হয় না কিন্ত আমার বেলায় হলে মতাব্বরা আমাকে ঘরছাড়া করে।
পরিবারে সবার শেষে আমাকে ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ- ডিনার করতে হয়।সবার শেষে আমাকে ঘুমাতে হয় আবার সবার আগে আমাকেকে বিছানা ছাড়তে হয়। কিন্ত পুরুষের স্বাধীনতাটা সে নিজে ঠিক করে!
অবোলা শিশু তুমি ভূলে গেছো মধ্যরাতে তোমার ভয়ার্ত ক্রন্দনে ঘুম পাড়ানির গান শুনে কার বক্ষ জড়িয়ে ঘুমেরদেশে পাড়ি দিয়েছিলে? সেছিলাম আমি । তুমি বড়ো হলে বিয়ে করলে ভালো ঘরটা তোমার জন্য ছেড়ে দিয়ে কে হাড়কাঁপানো শীতে বারান্দায় তাবু টাঙিয়ে বিনিদ্রাযাপন করছিল? সেছিলাম আমি । হাজারবার আমি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছি আমার সন্তানপ্রসবের প্রাক্কালে অথচ প্রফেসার ছেলের নির্মম হস্তদয়ে অট্টালিকা থেকে আমি ভূপতিত হলাম! দুমুঠো অন্নের অধিকার আদায়ে আমাকে আদালতে মামলা করতে হয়!!! শত কস্ট হৃদয়ে লালন করেও আমি কি বলেনি-“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”?
সভ্যতার ফানুসে,ইতিহাসের বিশ্লেষণে, অত্যাধুনিক যান্ত্রিকতার উন্নয়নে মাতৃদিবস পালিত হয়। আমি কি আমার সন্তান স্নেহের জন্য পুত্র-পুত্রী দিবস পালন করেছিলাম?
আমার ভক্তি-সেবা-যত্নের সময় নির্দিস্ট দিনে সীমাবদ্ধ। আমার দূর্বলতার সুযোগে তোমরা কত কি কর। আমার অধিকারে তিনতালাকেও সরব হও আবার আমার সতীত্বনাশে বার-পতিতালয় খুলে রাখো! ক্ষমতারলোভে আমাকে নগ্ন করে মুর্খের দেশে বুদ্ধিজীবি সেজে সেলেক্টিভ প্রটেস্ট মেকানিজিমে পা মেলাবেন? নজরুলকে কি আজও বলতে হবে “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

যৌতুকের জন্য আমাকে পিটাও। নির্লজ্জ পুরুষ তুমি কি বিয়ের সময় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে স্বীকার করোনি যে আমি সব দায়িত্ব নিয়ে তোমাকে গ্রহন করলাম?
আমার টাকায় এত লোভ আর পুরুষ হয়ে বিরত্ব দেখাও! ফুটপাটের পোষাকে আর হাওয়ায় চপ্পলে জীবন কাটালে আবার বিয়ের সময় ব্রান্ড খুঁজো! আসলে তুমি সমাজের নপংসুক। জীবনে সকালবেলা এককাপ চা জোটেনি তোমার একটা চাকরি জোগাড় করে দারিদ্রতার অতীত ভূলে আমার পিতার খু্ঁজো ধন। আপনি কি একটুও ভাবেন না আমি কারোর মা,বোন,মাসি-পিসি,মেয়ে? কোন অজুহাতে আমায় দমিয়ে রাখো? আমাকে কোনোদিন পাচিলের ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে দেওয়া হয়নি,বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা পা রাখতে দেওয়া হয়নি ,কর্মক্ষেত্রে যেতে দেওয়া হয়নি সমাজের নানা ফতুয়ায় আমার অধিকার হরন করে কোন লজ্জায় আমার কাছে হাতপাতো।আমার অভিশাপ তোমাদের উপর বর্ষিত হবে। কারণ কোনকালেই আমাকে সম্মান করনি।সম্প্রতি আমাকে মায়ানমারে ধর্ষন করলে, ভূস্বর্গে এখনও আমাকে ধর্ষন করে চলেছো,আমি মুক্তি যুদ্ধে ধর্ষিত হহয়েছি,দেশভাগের প্রাক্কালে ধর্ষিতা,ভূ-স্বর্গের ধর্ষিতা,আমি গুজরাটের সেই নারী যার পেট চিরে ভ্রুণ বের করে ত্রিশূলের ডগায় ঢুকিয়ে নারকীয়ভাবে নেচেছিলে, আমি সেই নারী,যার পেটে নাজিব,পেহলু খান ও রোহিত ভেমুলাদের জন্ম হয়েছিল , আমি মনিপুরের দীর্ঘ সময়ের অনশনকারিনী, একাবিংশ শতাব্দীতেও তোমরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে মাতৃদিবস পালন কর আর কতদিন হায়না সেজে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে কলঙ্কিত করে পৃথিবীকে সভ্যনামে ডাকবে?